বৃহস্পতিবার, ০৯ অক্টোবর ২০২৫, ০৬:০৩ পূর্বাহ্ন
মাওলানা সাখাওয়াত উল্লাহ
সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিস্থিতিতে ঈদুল ফিতর পালিত হতে যাচ্ছে এবার। সারাদেশে মহামারী ছড়িয়ে পড়ার পেক্ষাপটে আমাদের সবাইকে সুরক্ষা নিশ্চিত করে ঈদ পালন করতে হবে। আর এজন্য ঈদের ময়দানের জমায়েত এড়িয়ে মসজিদে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে ঈদের নামাজে শামিল হতে হবে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মুসল্লীদের ঘরে বসে পরিবারের সঙ্গে ঈদের নামাজ পালনের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। আমাদের দেশে কোলাকুলি ও করমর্দন থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। নিজেদের স্বার্থে এ নির্দেশনাগুলো আমাদেরকেও অনুসরণ করতে হবে। মাসব্যাপী সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আমরা যে সংযম ও দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছি তা অনুসরণ করতে হবে ঈদের দিনও। মহান আল্লাহ যেন পৃথিবী থেকে মহামারী দূর করে দেন সে দোয়া করতে হবে।
ঈদুল ফিতর একাধারে আনন্দোৎসব ও ইবাদত। এ আনন্দ আল্লাহর রহমত ও ক্ষমাপ্রাপ্তির, জাহান্নাম থেকে মুক্তির। এ আনন্দ সিয়াম-কিয়ামের শুকরিয়া ও কৃতজ্ঞতার। এ আনন্দে নেই কোনো অশ্লীলতা ও পাপ-পঙ্কিলতা। এ আনন্দে শুধুই সওয়াব ও পুণ্যময়তা। ধীরে ধীরে এ আনন্দ ছড়াতে থাকে হৃদয় থেকে হৃদয়ে। সদ্যপ্রসূত শিশু থেকে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা সবার দেহ-মনে ঈদের ছোঁয়া লাগে। হতদরিদ্র, এতিম, দুস্থ, নিঃস্ব ও শত শত ছিন্নমূল মানুষের মুখেও হাসি ফোটে।
ঈদ মানেই আনন্দ। ঈদুল ফিতর অর্থ রোজা খোলার আনন্দ। কিন্তু কেন সেই আনন্দ? আনন্দের জন্য তো কোনো কারণ থাকতে হবে! সুখবর পেলেই তো মানুষ আনন্দিত হয়! এক মাস রোজার সাধনার পর এই দিনে সেই সাধনার পুরস্কার হিসেবে ক্ষমা পাওয়াই সেই আনন্দের কারণ। আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেন, আল্লাহতায়ালা ঈদের দিন ফেরেশতাদের মধ্যে রোজাদারদের নিয়ে গর্ব করে বলেন, ‘হে ফেরেশতারা, আমার কর্তব্যপরায়ণ প্রেমিক বান্দার বিনিময় কী হতে পারে?’ ফেরেশতারা বলেন, ‘হে প্রভু, পুণ্যরূপে পুরস্কার দান করাই তো তার প্রতিদান।’ আল্লাহ বলেন, ‘আমার বান্দারা তাদের ওপর অর্পিত দায়িত্ব (রোজা) পালন করেছে। অতঃপর দোয়া করতে করতে ঈদগাহে গমন করেছে। সুতরাং আমার মর্যাদা, সম্মান, দয়া ও বড়ত্বের কসম! আমি তাদের দোয়া কবুল করব এবং তাদের মাফ করে দেব।’ (বায়হাকি : ৩/৩৪৩)
মুসলমানদের ঈদ সংস্কৃতির আগে মদিনায় ‘নওরোজ’ ও ‘মেহেরজান’ নামে দুটি উৎসব পালিত হতো। দুটি উৎসবই পারস্য সংস্কৃতি ও সভ্যতার দর্পণ। বর্ষবরণকে কেন্দ্র করে নওরোজ এবং বসন্ত উৎসবকে উপলক্ষ করে মেহেরজান নামে দুটি বিনোদনমূলক উৎসব পালন করা হতো। মানবতার নবী মুহাম্মদ (সা.) দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা দিলেন, ‘প্রতিটি জাতির আনন্দ-উৎসব আছে। আর আমাদের আনন্দ-উৎসব হলো দুই ঈদ।’ (বুখারি, হাদিস : ৯৫২)
ইসলামের দেওয়া দুটি আনন্দ-উৎসবের সঙ্গে মিশে আছে আমাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্য। ঈদ আমাদের শিক্ষা দেয় ত্যাগের। ভেদাভেদ ভুলে যাওয়ার। শ্রেণিবৈষম্যের মূলোৎপাটন করার। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে গরিব-ধনী এককাতারে চলার; কিন্তু আমরা কোন ধরনের সংস্কৃতির চর্চা করছি ঈদের আদলে? মানুষ আজ ঈদকে বানিয়ে ফেলেছে বিভেদের সুবিস্তৃত মাঠ। ঈদের দিনে মানুষ হয়ে যাচ্ছে মানুষ থেকে ভিন্ন। এলিট-নিম্নস্তরের মানুষের মধ্যে সৃষ্টি হচ্ছে যোজন যোজন ফারাক। পৃথিবীর এ বিচিত্র পাঠশালার মধ্যে আমরা ভুলে যাচ্ছি আমাদের সভ্যতার সংস্কৃতি ও শিকড়ের শিক্ষা।
ইসলাম বিনোদন সমর্থন করে; কিন্তু অশ্লীলতাকে মোটেও প্রশ্রয় দেয় না। বিনোদনের নামে অসামাজিকতা ও নগ্নতা নেই। ইমানদারের ঈদের আনন্দ উত্তম পোশাক পরিধান, ঈদের দিন মিষ্টিমুখ করা, সদকাতুল ফিতর আদায় ও ঈদের নামাজ আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। উৎসবের সঙ্গে মানুষের রুচি ও চাহিদার বিষয়টি জড়িত। অন্যদের উৎসব ও আমাদের উৎসবের মধ্যে পার্থক্য আকাশ-পাতাল। মুসলমানদের উৎসব অপসংস্কৃতি থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত। উৎসবের নামে অনাচার, কদাচার, পাপাচার আর নৈতিকতাবিবর্জিত বল্গাহীন অনুষ্ঠান আড়ম্বরের অবকাশ নেই ইসলামে। আবার বৈধ ও নির্দোষ আনন্দ-ফুর্তি, শরীরচর্চামূলক খেলাধুলা এগুলোও ঈদের দিনের বৈধ আনুষ্ঠানিকতার বাইরে নয়। আয়েশা (রা.) বলেন, ঈদের দিন হাবশিরা খেলা করছিল। রাসুল (সা.) ক্রীড়ারত হাবশিদের উৎসাহ দিয়ে বলেছিলেন, ‘ছেলেরা, খেলে যাও! ইহুদিরা জানুক যে আমাদের দ্বীনের প্রশস্ততা আছে। আমাকে প্রশস্ত দ্বীনে হানিফসহ প্রেরণ করা হয়েছে।’ (বুখারি : ১/১৭৩; মুসলিম : ২/৬০৮)
ঈদের দিনের বিভিন্ন আমল : (১) মেসওয়াক করা সুন্নত। (২) গোসল করা সুন্নত। (৩) সুগন্ধি ব্যবহার করা সুন্নত। (৪) কিছু খেয়ে ঈদগাহে যাওয়া সুন্নত। বিজোড় সংখ্যায় যেকোনো মিষ্টিদ্রব্য খাওয়া উত্তম; খেজুর অতি উত্তম। (৫) ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া উত্তম। এক রাস্তা দিয়ে যাওয়া অন্য রাস্তা দিয়ে আসা মুস্তাহাব। (৬) ঈদগাহে যাওয়ার পথে নিচু স্বরে তাকবির (আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবার, ওয়া লিল্লাহিল হামদ) পড়া সুন্নত। (৭) সাধ্যমতো উত্তম পোশাক পরিধান করা মুস্তাহাব। (৮) নামাজের জন্য ঈদগাহে যাওয়ার আগে সদকায়ে ফিতর আদায় করা সুন্নত। (দাতা ও গ্রহীতার সুবিধার্থে রমজানেও প্রদান করা যায়)। (৯) ঈদের দিন চেহারায় খুশির ভাব প্রকাশ করা ও কারও সঙ্গে দেখা হলে হাসিমুখে কথা বলা মুস্তাহাব। (১০) আনন্দ-অভিবাদন বিনিময় করা মুস্তাহাব। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৬, ৫৫৭, ৫৫৮; হেদায়া : ২/৭১; বোখারি : ১/১৩০, ইবনে মাজাহ : ৯২)
ঈদের নামাজ দুই রাকাত আর তা ওয়াজিব। এতে আজান ও ইকামত নেই। যাদের ওপর জুমার নামাজ ওয়াজিব, তাদের ওপর ঈদের নামাজও ওয়াজিব। ঈদের নামাজ ময়দানে পড়া উত্তম। তবে মক্কাবাসীর জন্য মসজিদে হারামে উত্তম। শহরের মসজিদগুলোতেও ঈদের নামাজ জায়েজ আছে। (বুখারি : ১/১৩১; ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৫, ১/৫৫৭; আল মুহাজ্জাব : ১/৩৮৮)
সূর্য উদিত হয়ে এক বর্শা (অর্ধ হাত) পরিমাণ উঁচু হওয়ার পর থেকে শুরু হয়ে দ্বিপ্রহর পর্যন্ত বাকি থাকে। তবে ঈদুল ফিতরের নামাজ একটু দেরিতে পড়া সুন্নত; যেন নামাজের আগেই বেশি থেকে বেশি সদকাতুল ফিতর আদায় হয়ে যায়। (ফাতহুল কাদির : ২/৭৩, আল মুগনি : ২/১১৭)
মুখে উচ্চারণ করার কোনো প্রয়োজন নেই। মনে মনে নির্দিষ্ট করতে হবে যে আমি এ ঈদের নামাজ কিবলামুখী হয়ে এই ইমাম সাহেবের পেছনে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে আদায় করছি। ঈদের নামাজে অতিরিক্ত ছয়টি তাকবির ওয়াজিব। প্রথম রাকাতে তাকবিরে তাহরিমা ও ‘ছানা’র পর তিন তাকবির। দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর রুকুতে যাওয়ার আগে তিন তাকবির। এ তাকবিরগুলো বলার সময় ইমাম-মুকতাদি সবাইকে হাত উঠাতে হবে। তৃতীয় তাকবির ছাড়া প্রতি তাকবিরের পর হাত ছেড়ে দিতে হবে। কেউ যদি এ তাকবিরগুলো না পায়, তাহলে সে রুকুতে থাকা অবস্থায় আদায় করে নিতে হবে। কারো পূর্ণ এক রাকাত ছুটে গেলে সে দ্বিতীয় রাকাতে কেরাতের পর তাকবিরগুলো আদায় করে নেবে। কেরাতের আগে আদায় করারও সুযোগ রয়েছে। নামাজ শেষে খুতবা প্রদান ইমামের জন্য সুন্নত; তা শ্রবণ করা নামাজির জন্য ওয়াজিব। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৫৯, ৫৬০)
কারও ঈদের নামাজ ছুটে গেলে শহরের অন্য কোনো জামাতে শরিক হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। যদি নামাজ ছুটেই যায়; তাহলে এর কোনো কাজা নেই। তবে চার রাকাত এশরাকের নফল নামাজ আদায় করে নেবে; এতে ঈদের নামাজের মতো অতিরিক্ত তাকবির বলবে না। (ফাতাওয়া শামি : ১/৫৬১)। সূত্র:দেশরূপান্তর।
ভয়েস/জেইউ।